শ্রবণ কুমার (৩০) প্রতিদিনের রুটিন মেনে চলে ঘড়ির কাঁটার মতো — ভোরে ওঠা, কফি খাওয়া, যোগব্যায়াম, আর ল্যাপটপে কপি-টাইপিং। সে চেন্নাইতে থাকে তাঁর মা রেমা কে (৫৫), বাবা রামকৃষ্ণন (৫৯), ছোট বোন শ্রেয়া (২৩) এবং ঠাকুরদা বীররাঘবনের (৮৯) সঙ্গে। সে স্নেহময়, এবং সবার স্নেহভাজন।
চিত্রটা নব্বই দশকের শুরুতে। তখন এত সুখের পারিবারিক দৃশ্য ছিল না। রেমা তখন ২৩ আর রামকৃষ্ণন ২৮। সদ্যবিবাহিত দম্পতির ঘরে প্রথম সন্তান এল — “সুন্দর, হাসিখুশি, সুস্থ” রেমা স্মৃতিচারন করেন। কিন্তু আত্মীয়রা যখন বলতে লাগল শিশুটি একটু “ভিন্নরকম” দেখতে, তখন তাঁদের আনন্দে ভাঁটা পড়ে। এমনকি তাঁদের পারিবারিক ডাক্তারও বলে ফেলেন, “চেহারাটা একটু মঙ্গোলয়েড জাতীয় লাগছে।” তারপর এক শিশুবিশেষজ্ঞের কাছ থেকে এল সেই নিষ্ঠুর বাক্যসমেত ডাউন সিনড্রোমের নির্ণয়: “এই বাচ্চাটা একেবারে অকাজের। আরেকটা নিন।”
রেমা বলেন, “ওই দিনই প্রথম আমার স্বামীকে কাঁদতে দেখেছিলাম।” কিন্তু মা’কে অবজ্ঞা করলে সর্বনাশ! “সেদিনই আমি একটা অঙ্গীকার করলাম,” বলেন রেমা। “আমি এই ছেলেটার জন্য আছি।” তখনকার সময়ে, এমনকি চিকিৎসাক্ষেত্রেও বুদ্ধিবিকাশজনিত প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে সচেতনতা ছিল খুব কম। ভারতে প্রথম প্রতিবন্ধিতা আইন পাশ হয় ১৯৯৫ সালে। “তখন তো গুগল ছিল না, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপও ছিল না, ইনক্লুসিভ স্কুলের তো প্রশ্নই নেই,” বলেন রেমা, যিনি শ্রবণকে শিক্ষিত করতে গিয়ে নাজেহাল হয়ে পড়েছিলেন। “স্কুলে স্কুলে গিয়েছি, সবাই ফিরিয়ে দিয়েছে।”
'দ্য হিন্দু' পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ পড়ে রেমা খোঁজ পান রেখা রামচন্দ্রনের — যিনি ডাউন সিনড্রোম অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়ার প্রেসিডেন্ট। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে সাহস পান শ্রবণকে মেইনস্ট্রিম স্কুলে ভর্তি করাতে। কিন্তু অভিজ্ঞতা সুখকর ছিল না। অন্য অভিভাবকেরা অভিযোগ করতেন, শিক্ষকরা বলতেন অন্য বাচ্চারাও শ্রবণের মতো আচরণ করে ফেলবে! বহু চেষ্টার পর অবশেষে তাঁকে ভর্তি করানো হয় অপরচুনিটি স্কুল-এ, একটি বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের স্কুল। শ্রবণ পরে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ওপেন স্কুলিং (NIOS) থেকে দশম শ্রেণি পাশ করে।
শ্রবণ যখন তিন বছরের, তখন রেমা টেলিকম সেক্টরে চাকরি শুরু করেন এবং প্রায় কুড়ি বছর কাজ চালিয়ে যান। তিনি মনে করেন, যেখানে সম্ভব, মায়েদের উচিত কাজ করা। “পিতামাতার নিজের সময় থাকা দরকার,” বলেন রেমা। “চাকরি করলে মন শান্ত থাকে, অনেক কিছু শেখা যায়।” বাড়ি ফিরে তিনি সন্তানদের সঙ্গে কাটানো কয়েক ঘণ্টার “কোয়ালিটি টাইম” যথেষ্ট ছিল তাঁদের বেড়ে ওঠার জন্য। উপরন্তু, তাঁর শ্বশুরবাড়ি ও বাবারবাড়ির সকলে বড় ভূমিকা নেন শ্রবণ ও শ্রেয়ার লালনপালনে।
শ্রেয়ার জন্মও ছিল সচেতন সিদ্ধান্তের ফল, একাধিক ডাক্তারি পরামর্শের পর। এখন সে চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সি পরীক্ষার শেষ ধাপে, আর ভাইয়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক গভীর। “ও এক আশীর্বাদ,” বলেন রেমা। “শ্রবণ ওকে খুব ভালোবাসে। ওদের মধ্যে এক বিশেষ আবেগঘন বন্ধন রয়েছে।” কিন্তু ১৫ বছর বয়সে শ্রবণের মধ্যে উদ্বেগের লক্ষণ দেখা যায়। পরে তাঁর হালকা বিষণ্নতা ও স্লিপ অ্যাপনিয়ার নির্ণয় হয় — ডিএস-এর ক্ষেত্রে সাধারণ। একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ওষুধ দেন, যা আজও তাঁকে সাহায্য করছে।
শ্রবণের জীবনে এক বড় পরিবর্তন আসে ফিটনেসের মাধ্যমে। সে প্রতিদিন ব্যায়াম করতে থাকে। “অনেকে জিমের ফি দেয় আর যায় না। শ্রবণ রোজ যেত,” বলেন রেমা গর্বের সঙ্গে। ১০ কেজি ওজন কমায় সে, আর জিম কর্মচারীরা শ্রদ্ধায় তাকিয়ে থাকেন। এমনকি ওকে “ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর”ও বানান, ওর ছবি টাঙানো হয় প্রবেশদ্বারে!
কোভিডের সময় তার অ্যাডাল্ট ট্রেনিং সেন্টার বন্ধ হয়ে যায়, তারপর থেকে সে আর বাইরে যায় না। “২৮ বছর বাইরে গিয়েছে। এখন সে বাড়িতেই থাকতে ভালোবাসে, নিজের গতিতে কাজ করে,” বলেন রেমা। “যা-ই করুক, মন দিয়ে করে। আমাদের সবার চেয়ে বেশি নিয়মানুবর্তী। সকাল ৬টায় ওঠে, যোগা করে, ডেটা টাইপ করে, প্রার্থনা করে, নিজের রুটিন মেনে চলে।” সে সহজ টাইপিং ও ডেটা এন্ট্রির কাজ করে। “একবার একটা প্রজেক্ট থেকে ওর মাসে পাঁচ হাজার টাকা রোজগার হয়েছিল। ওর আত্মবিশ্বাস বেড়েছিল।” নিজের ঘর নিজেই পরিষ্কার রাখে, জামা কাপড় গুছিয়ে রাখে, ছোট ছোট দৈনন্দিন কাজ একাই করে।
শ্রবণের সংবেদনশীলতা আর ভালোবাসা চারপাশের সবাই জানে। “ও খুব সামাজিক,” রেমা বলেন। “সবাইকে ভালোবাসে, পাড়াপ্রতিবেশীদের সঙ্গে ৫-১০ মিনিট হলেও কথা বলতে ভালোবাসে।” ঠাকুরদার সঙ্গে ওর সম্পর্কটা খুবই ঘনিষ্ঠ। বীররাঘবনের যখন পা ভেঙে গিয়েছিল শ্রবণ খুব কষ্ট পেয়েছিল। “মন্দিরে গিয়ে আমাদের সবার জন্য প্রার্থনা করে,” বলেন রেমা। “সবসময় বলে ‘আমার ঠাকুরদাদু-ঠাকুমা সুস্থ থাকুক’। আর ও কখনো অভিযোগ করে না; জ্বর বা ব্যথা হলেও চুপচাপ শুয়ে থাকে।”
ভবিষ্যতের জন্য শ্রবণকে প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত করার চেষ্টা চলছে — অন্তত যেন নিজে মোবাইলে খাবার অর্ডার করতে পারে, বা কাছের ক্যান্টিনে ফোন করে খাবার আনাতে পারে। বাড়ির বড়রা বলেন, “আমরা থাকব, তারপর ঈশ্বর দেখবেন। শ্রেয়া তো আছেই ওর জন্য।”
রেমা বলে“এই পৃথিবীতে প্রতিটি প্রাণীরই কোনও না কোনও কাজে লাগে। ঈশ্বর সবাইকে সেভাবেই সৃষ্টি করেছেন। শ্রবণ আমাদের তা শিখিয়েছে। ও-ই আমাদের অনুপ্রেরণা।”