আসামের কাছাড় জেলার কনকপুর গ্রামের ৪৭ বছর বয়সী জয়নাল হোসেন লস্কর ইমিটেশনের গয়না আর চুড়ি বিক্রি করে সংসার চালান। প্রতিদিন সাইকেলে চেপে আশেপাশের গ্রাম ঘুরে বেড়ান তিনি। রাত ৯.৩০-১০টা নাগাদ তিনি যখন ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে বাড়ি ফেরেন, তখন তাঁর ছোটো কন্যা প্রিয়া বেগম (১৪) তাঁকে অভ্যর্থনা জানায়। নিজের জামা দিয়ে বাবার ঘাম মুছে দেয় সে, জল এনে দেয় আর অনুরোধ করে খেতে বসতে।
“সে সাইকেল চালানো শিখতে চায়, এমনকি ই-রিকশাও চালাতে চায়,” চোখে জল নিয়ে হাসিমুখে জয়নাল বলেন। “সে রোজগার করতে চায়, যেন আমি একটু বিশ্রাম নিতে পারি।” প্রিয়া একজন বিকাশগত প্রতিবন্ধী এবং তাঁর কথার সমস্যা আছে, ফলে সে মুখে কিছু বলতে পারে না। সে ইশারা ও মুদ্রার মাধ্যমে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে। দুর্বল হাড়ের গঠন, অস্থির হাঁটা এবং হাঁটার সময় শ্বাসকষ্ট—এই সব কিছুর মধ্যেও তার উৎসাহ বা শেখার আগ্রহ এতটুকু কমেনি।
প্রিয়া স্থানীয় সরকারি বিদ্যালয় 'স্বাস্থ্য সাধনা মধুবনি এল পি স্কুল’-এর পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। সে নীরবে পড়ে এবং বই থেকে পুরো অধ্যায় হুবহু নিজের খাতায় লিখে রাখে। “সে উচ্চস্বরে পড়তে পারে না, কিন্তু তার খাতা ভর্তি। এভাবেই সে শিখে চলেছে” গর্বের সঙ্গে বলেন তাঁর মা বেবি বেগম লস্কর (৪১)। তবে, তাকে যদি নজরে না রাখা হয় সমস্যা হতে পারে। দু’বার সে স্কুল থেকে হারিয়ে গিয়েছিল—একবার খেলার সময় হঠাৎ চলে গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলেছিল।
বাড়িতে প্রিয়া অনানুষ্ঠানিকভাবে শেখে, যখন তাঁর দিদি জিয়া (২৩) পাড়ার ছেলেমেয়েদের পড়াতে বসে। “সে পাশে বসে মনোযোগ দিয়ে শুনে। কিছুই বাদ দেয় না,” বলেন জিয়া। “বই, কলম আর খাতা—এইসব জিনিসই তাকে সবচেয়ে খুশি করে।” জিয়ার বোর্ড পরীক্ষার সময়, তার বাবা দুর্ঘটনায় পড়ে পায়ে চোট পান। “আমি ভালভাবে প্রস্তুতি নিতে পারিনি, তাই ফেল করি,” বলেন জিয়া। “তারপর থেকেই পড়ানো শুরু করি। এখন মাত্র পাঁচজন ছাত্রছাত্রী আছে, কিন্তু কিছুটা রোজগার হয়। আমার প্রিয় বিষয় ছিল ইংরেজি; এখনও সময় পেলে গল্পের বই পড়ি।”
জিয়া প্রিয়ার থেকে নয় বছর বড়, সবসময় তাঁর দেখভাল করে। “প্রিয়া আমার সন্তানের মতো,” সে বলে। “আমি ওকে স্নান করিয়ে দিই, খাইয়ে দিই, খেলতে নিয়ে যাই। এখনো ওর দেখাশোনা করি।” সে নিজের পাকা বিয়ে দু’বছরের জন্য পিছিয়ে দিয়েছে পরিবারের পাশে থাকার জন্য। “আমাদের সমাজে বিয়ে মানে বাবা-মায়ের সঞ্চয় শেষ হয়ে যাওয়া, সেটা আমি চাইনি,” সে বলে। “আমি আমার বোনকে সাহায্য করতে চাই, আর আমার মাকেও, যাঁর থাইরয়েড আর হাই ব্লাড প্রেসার আছে। ওঁদের ওষুধ কেনার খরচ আমি দিই।”
“আমার দুই মেয়ে আমার দুই কাঁধ,” বলেন জয়নাল। “ওরাই আমার আশা।” মাসে ৭০০০ টাকা আয়ে তিনি পাশের বাড়িতে থাকা বৃদ্ধ মা-বাবাকেও সামলান। তাঁর ছোট ভাই কামাল হোসেন লস্কর মণিপুরে মেকানিকের কাজ করেন, তাঁর স্ত্রী ও সন্তানরা কাছেই থাকেন। জয়নাল দু’টো বাড়ির বাজার, কাজকর্ম আর বিল মিটিয়ে তবেই নিজের পথে বের হন।
২০১৯ সালে প্রিয়া প্রতিবন্ধকতার শংসাপত্র পেলেও এখনও অবধি আসাম সরকারের আর্থিক সহায়তা প্রকল্প 'অরুণোদয়'-এর কোন সুবিধা পায়নি। “আমরা আবেদন করেছি। এখনও কোনও জবাব মেলেনি। কিন্তু আমি থামব না। ওর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে হবে, যদি আমরা না থাকি,” বলেন জয়নাল।
প্রিয়া গান শুনতে ভালোবাসে। “সে এতক্ষণ নাচে যতক্ষণ না নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। তারপর বসে পড়ে আর শুধু সুরে মাথা দোলায়,” বলে জিয়া। “আমি এখনো অপেক্ষা করি, যদি কোনও দিন ওর মুখে কিছু শুনতে পাই।” ডাক্তারদের কথামতো, একবার সম্ভাবনা বলা হয়েছিল—“২০ বছর বয়সে ও কথা বলতে শুরু করতে পারে,” বলেন মা বেবি। “তাই আমরা অপেক্ষা করি। ততদিন যতটা সম্ভব ভালোবাসা দিয়ে ওকে ঘিরে রাখি।” কিন্তু প্রিয়ার কথা না বলতে পারা তার দৈনন্দিন জীবনে বিশেষ অসুবিধা করে না। “সে সব বোঝে,” জিয়া বলে। “আজান শুনলে ও দোপাট্টা নিয়ে আসে আর আমায় নামাজ পড়তে বলে। এমনকি আমি যখন নামাজ পড়ি, তখন আমার অনুকরণ করে।”
প্রিয়া ঝাল খেতে ভালোবাসে—মায়ের রান্না করা মশলাদার মুরগির ঝোল আর পিসির হাঁসের ডিমের ঝোল তার প্রিয়। সে স্টাইলিশ সুতির জামা পরতে ভালোবাসে। বাবার বা দিদির সঙ্গে বাজারে গেলে সে পছন্দের জামা দেখিয়ে দেয় এবং ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে—কারণ সে জানে, একদিন না একদিন সেই জামা তার কাছে পৌঁছে যাবে।
জয়নাল এখন একটু শান্ত জীবনের স্বপ্ন দেখেন। “প্রতিদিন সাইকেল চালানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে। জিয়ার বিয়ের পর একটা ছোট দোকান ভাড়া নেওয়ার চেষ্টা করব,” বলেন তিনি। কিন্তু ততদিন তিনি তাঁর ঘাম ঝরিয়ে গোটা পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে চলতেই থাকবেন।